রেসিপির গল্প এবং কেন এই রেসিপিটি বিশেষ?
রসকরা বা ক্ষীরের নাড়ু বাঙালি সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা শুধুমাত্র একটি মিষ্টি নয় বরং আমাদের ঐতিহ্য ও ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। নারিকেল, ক্ষীর আর চিনির নিখুঁত মিশ্রণে তৈরি এই মিষ্টি বহু প্রজন্মের প্রিয়। শরতের সকালের মিষ্টি সুবাস, পিঠে-পুলির সাথে রান্নাঘরে মা, ঠাকুমা বা দাদীর ব্যস্ততা—সবকিছু যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে এই রসকরার স্বাদে।
এটি শুধু স্বাদের কারণে নয় বরং আমাদের শেকড়ের স্মৃতির সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে এতটা বিশেষ। ঘন ক্ষীরের মিষ্টি স্বাদ আর টাটকা নারিকেলের টেক্সচার রসকরাকে করে তোলে অতুলনীয়।
এটি এমন একটি মিষ্টি যা উৎসব থেকে পারিবারিক আড্ডা, সবখানেই পরিবেশন করা যায়। এমনকি বাড়ির উপর চলে আসা হঠাৎ ক্লান্ত পথিককেও দেয়া যায় এবং প্রতিটি কামড়ে ভালোবাসার অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে।
কেন এটি খেতে ভালো লাগবে:
১. নারিকেল আর ক্ষীরের মোলায়েম টেক্সচার মুখে দিলেই গলে যায়।
২. এটি এমন এক ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি যা উৎসব এবং ঘরোয়া পরিবেশে সমানভাবে মানানসই।
৩. স্বাদে অতুলনীয় হলেও এটি বানানো সহজ এবং প্রক্রিয়াটি আনন্দদায়ক।
৪. ক্ষীরের গভীর সুবাস আর নারিকেলের সুগন্ধ প্রতিটি বাঙালির মনে শেকড়ের টান জাগিয়ে তোলে।
কী কী লাগবে এই রসকরা তৈরি করতে:
১. টাটকা নারিকেল কোড়া
২. ঘন দুধ বা ক্ষীর
৩. চিনি (স্বাদ অনুযায়ী)
৪. ঘি (আলতো গন্ধ এবং মোলায়েমতা আনতে)
স্বাস্থ্য উপকারিতা:
- নারিকেলে থাকা প্রাকৃতিক ফাইবার হজমে সাহায্য করে।
- ক্ষীর শরীরকে শক্তি যোগায় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- ঘি শরীরের জন্য উপকারী চর্বির একটি উৎকৃষ্ট উৎস।
- রসকরা সহজে হজমযোগ্য এবং তৃপ্তিদায়ক।
পরিবেশন:
রসকরা পরিবেশন করুন উৎসবের পাতে বা সাধারণ বিকেলের চায়ের সঙ্গে। একটু পেস্তা বা নারিকেল কোরা ছড়িয়ে দিলে এটি দেখতে আরও সুন্দর এবং আকর্ষণীয় লাগবে। যদিও শুধু রসকরাও স্বাচ্ছন্দে পরিবেশন করা যায়।
রসকরা এমন একটি মিষ্টি, যা শুধুমাত্র খাওয়ার জন্য নয়, পরিবারের সবার সঙ্গে মধুর মুহূর্ত ভাগ করে নেওয়ার জন্যও তৈরি করা হয়। এটি শীতের দিনে একটি উষ্ণ অনুভূতি আনে, আর আমাদের শিকড়ের স্মৃতিকে জীবন্ত করে তোলে।
তাহলে আর দেরি কেন? চলুন, ভালোবাসা আর যত্ন দিয়ে তৈরি করি ঐতিহ্যবাহী রসকরা, যা প্রতিটি কামড়ে আপনাকে শেকড়ের স্পর্শ এনে দেবে এবং আপনার পরিবারের ভালোবাসার আরও একটি নতুন গল্প তৈরি করবে। 

রসকরা বা ক্ষীরের নাড়ু তৈরির ঘরোয়া পদ্ধতি
ঘন ক্ষীরের মোহনীয় স্বাদ আর নারিকেলের নরম টেক্সচারে ভরা রসকরা! শরতের মিষ্টি পরিবেশে বা উৎসবের আমেজে, এই মিষ্টি মুহূর্তগুলোকে করে তোলে আরও আনন্দময়। পুরানো দিনের স্মৃতি সাথে এক কাপ চা অথবা মিষ্টান্নের সঙ্গেও একদম পারফেক্ট এটি!
Prep Time 1 hour hr
Cook Time 45 minutes mins
Course Dessert
Cuisine Bengali
Servings 10
Ingredients
- ১.৫ লিটার দুধ
- ৪ কাপ নারিকেল কোড়া
- ১.৫ কাপ চিনি
- ১/৩ চা চামচ এলাচের গুঁড়ো
Instructions
- রসকরা তৈরির প্রথম ধাপে ঘন ক্ষীর তৈরির জন্য একটি বড় ও ভারী পাত্রে দুধ ঢেলে নেবো। এই ক্ষেত্রে তাজা, ফ্যাটযুক্ত দুধ ব্যবহার করতে পারলে ক্ষীরটা যেমন ভালো হবে, রসকরা খেতে আরও ভালো লাগবে।দুধ ঘন এবং ফ্যাটযুক্ত হলে, ক্ষীর মজাদার এবং মোলায়েম হয় বেশ। স্থানীয় বাজারে পাওয়া খাঁটি গরুর দুধ এই রেসিপির জন্য সবচেয়ে ভালো। এছাড়া, ভারী তলার পাত্র ব্যবহার করলে দুধ সহজে পুড়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমে।
- এখন মাঝারি আঁচে দুধ ফোটাতে থাকুন। দুধ যখন ফুটতে শুরু করবে, তখন আঁচ কিছুটা কমিয়ে নিতে হবে। দুধ ফুটতে থাকলে, প্রতি ৩-৫ মিনিট পর পর একটি কাঠের চামচ বা স্প্যাচুলা দিয়ে দুধ ভালো করে নেড়ে নিন।
- দুধের তলায় জমে থাকা ঘন বা ক্রিমের মতো অংশ উঠিয়ে এনে দুধের সাথে মিশিয়ে নাড়তে থাকুন, যাতে সব অংশ সমানভাবে ফুটতে থাকে। এই নেড়েচেড়ে চলার প্রক্রিয়া দুধকে দানা-দানা না হতে দিয়ে পুরো দুধের সাথে একত্রিত করে মসৃণতা ধরে রাখে।
- ধীরে ধীরে, ৩০ মিনিট বা তার বেশি সময় ধরে দুধ ফুটানো হলে, খেয়াল করলে বোঝা যায় যে দুধের পরিমাণ কমে যাচ্ছে এবং ঘন হয়ে আসছে। এই সময় ধৈর্য ধরুন এবং দুধের ঘনত্ব পরখ করতে থাকুন। যদি আপনি দেখেন যে দুধ অনেক ঘন হয়ে যাচ্ছে এবং স্বর হয়ে আসছে, তবে বুঝবেন যে দুধ ঠিকভাবে ফুটছে।আর দুধ ফুটানোর এই মধ্যবর্তী সময়টায় নারিকেল কোরানোর কাজটি করতে পারেন।
- এই ধাপে রসকরা তৈরির জন্য আমরা নারিকেল কোরানোর কাজটি করবো। নারিকেল দুই ভাগ করে ফাটিয়ে নেয়ার পর একটি নারিকেল কোরানি বা গ্রেটারের সাহায্যে নারিকেলটি ভালোভাবে কুরিয়ে নিন।যদি সহজে নারিকেল কুরতে না পারেন, তবে নারিকেল টুকরো করে রেখে মিক্সার বা ব্লেন্ডারেও একসাথে পিষে নিতে পারেন।
- নারিকেল কুরানোর পর কিছু অতিরিক্ত পানি অনেক সময় বের হয়। সেই পানি একপাশে রেখে দিয়ে কুরানো নারিকেল ভালোভাবে পাত্রে রেখে দিন। তবে একদম ড্রাই করার দরকার নেই, এতে খড়খড়ে হতে পারে রসকরা।
- এবার কোরানো শেষ হলে অল্প সময় নিয়ে ব্লেন্ড করে নিন। এতে রসকরার টেক্সচার খুব ভালো আসবে।
- এবার মূল কাজ, একটি কড়াইতে নারিকেল কোরানো এবং চিনি একসাথে ভালো করে মিশিয়ে নিন। চিনি মিশানোর সময়, খুব ধীরে ধীরে নারিকেল এবং চিনি একে অপরের সাথে মিশিয়ে নিতে হবে। এই ক্ষেত্রে হাত দিয়ে মিশিয়ে নেয়াই সবচেয়ে ভালো।
- নারিকেলে ও চিনি মিশে গেলে চুলা ধরিয়ে খুন্তি বা স্প্যাচুলার সাহায্যে কিছু সময় নাড়তে থাকুন, যতক্ষণ পাক না আসে।
- এই সময়ে ক্ষীর প্রায় হয়ে এসেছে। দুধ ঘন হয়ে হালকা বাদামি রঙ ধারণ করবে। সাধারণত ৩০-৪০ মিনিটের মাঝেই দুধ ঘন হয়ে বুদ বুদ অরে ফুটতে শুরু করে। তবে সময় কম- বেশি হয়, দুধের পরিমাণ এবং আঁচের ওপর ভিত্তি করে।এই সময়টায় ধৈর্য নিয়ে অনবরত নাড়তে থাকতে হবে, যেন তলায় লেগে না যায়।
- এবার চুলার আঁচ বন্ধ করে ক্ষীর হালকা ঠান্ডা হতে দিন এবং এরপর পরবর্তী ধাপের জন্য ব্যবহার করুন।
- এখন তৈরিকৃত ক্ষীর পাক আশা নারিকেলের কড়াইতে দিয়ে দিবো। সেই সাথে মিশিয়ে নেবো কয়েক টুকরা এলাচ ও চিনি একত্রে মিশিয়ে গুঁড়ো করা পাউডার।
- এবার খুব ভালো করে নেড়ে মিশিয়ে নিলেই রসকরা তৈরির কাজ প্রায় শেষ।
- চুলা বন্ধ করে কড়াই নামিয়ে নেবার পর, হাত সহনীয় গরম থাকা অবস্থায় ছোট এক মুঠো পরিমাণ নিয়ে দুই হাতের তালুর মাধ্যমে গোল গোল করে গড়িয়ে নিন। প্রতিটি বল বা রসরা সমান মাপের হলে দেখতে আরও সুন্দর লাগবে। যদি মিশ্রণটি হাতে লেগে যায়, তাহলে হাতে সামান্য ঘি মাখিয়ে নিতে পারেন। এভাবে পুরো মিশ্রণটি দিয়ে মিষ্টিগুলো তৈরি করুন এবং ঠান্ডা হতে দিন। এই সময় সাথে অন্য কেউ কাজে সহযোগীতা করলে বেশ ভালো হবে।কারন, এই ধাপটি দ্রুত শেষ করতে হয়। পাক আসা মিশ্রণটি ঠান্ডা হয়ে গেলে বল তৈরি রসকরা ঠিক শেপে বানানো কঠিন হয়ে পরে।
- এবার একটি একটি করে রসকরা পাত্রে নামিয়ে রাখুন। ঠান্ডা হয়ে গেলে বয়াম বা অন্য কোনো পাত্রে রেখে দিন। এছাড়া কিছুটা নারিকেল কোরানো উপরে ছড়িয়ে দিয়ে গরম গরম অতি সুস্বাদু এই রসকরা পরিবারের সবাই মিলে উপভোগ করুন।
Notes
অতিরিক্ত টিপসঃ
১. ক্ষীর তৈরি একটি ধীর এবং ধৈর্যের কাজ। কখনো কখনো এক-দেড় ঘন্টাও লেগে যায় দুধের পরিমাণ বেশি হলে। ক্ষীরের জন্য দুধ মাঝারি থেকে কম আঁচে জ্বাল দিয়ে ঘন করুন। এতে দুধ ভালোভাবে ঘন হবে এবং ক্ষীরের স্বাদ আরও মজাদার হবে।
২. টাটকা দুধ ব্যবহার করলে ক্ষীর এবং রসকরার স্বাদ আরও বেশি মজাদার হয়। প্যাকেটজাত দুধের চেয়ে এটি অনেক ভালো।
৩. কোড়া নারিকেল হালকা ব্লেন্ড করলে রসকরার টেক্সচার আরও মসৃণ হবে, যা খেতে আরও আনন্দদায়ক।
৪. দুধ ঘন করার সময় বারবার নাড়ুন, যাতে দুধ নিচে লেগে না যায় এবং একটি সুন্দর ঘন ক্ষীর তৈরি হয়।
৫. চিনির পরিমাণ ঠিক রাখুন। বেশি মিষ্টি হলে তা খাওয়ার সময় ভারী বা দানাদার মনে হতে পারে।
পরিশেষে,
রসকরা বা ক্ষীরের নাড়ু আমাদের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি মিষ্টির মধ্যে অন্যতম। এর হয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস। যা প্রতিটি পরিবারে উৎসব ও আনন্দের সময় তৈরি হয়। এই মিষ্টি কেবল একটি রেসিপি নয়, আমাদের সংস্কৃতির একটি অংশ। ছোটবেলার মায়ের হাতে বানানো মিষ্টির স্মৃতি যেন এই রসকরার প্রতিটি টুকরায় জড়িয়ে থাকে।
আপনার হাতে তৈরি এই মিষ্টি পরিবারের সবার মনে আনন্দ আর ভালোবাসা ছড়িয়ে দেবে। এটি শুধু একটি খাবার নয় বরং বিশুদ্ধ ভালোবাসার মিশ্রণ। তাই সময় নিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে এই রেসিপিটি তৈরি করুন।
আপনারা যদি রসকরার মতো ঐতিহ্যবাহী রেসিপি ভালোবাসেন, তবে এটি ট্রাই করে অবশ্যই আমাদের জানাবেন। আপনার মন্তব্য এবং অনুভূতি আমাদের কাজের অনুপ্রেরণা। "Delicious Home Making" এর সঙ্গে রান্নার এই যাত্রায় আমাদের সঙ্গী থাকুন। কারণ, আমরা বিশ্বাস করি— "মজার খাবার তৈরি করে, স্মৃতি গড়ে তোলা হয় (Making Meals, Making Memories)" ❤️
Keyword Bengali Traditional Dessert, Roshkora, Kheer Naru, Traditional Bengali Recipe, রসকরা, নাড়ু, ঘরোয়া মিষ্টি রেসিপি, রসকরা বানানোর পদ্ধতি, ক্ষীরের মিষ্টি, বাঙালির মিষ্টি